শেষ পর্যন্ত আমি হয়ে উঠলাম একজন প্রবাসি।
কখনো ভাবিনি বন্দি পাখির মত যান্ত্রিক জীবন কাটাতে হবে। বরাবর আমি ছিলাম একজন শান্তি প্রিয় মানুষ।
যাই হোক, সে কথা পরে বলি,
আগে বলি আমার অতীত জীবনের সৃতি কথা।
ছেলেবেলা থেকে সাহিত্য কর্মকে ভালোবেসেছিলাম। বিশেষ করে সাহিত্য ছিল আমার উল্লেখযোগ্য দখল। আমি কোন নাম করা বিশিষ্ট জনপ্রিয় লেখক নই।
এই আর কি , অল্প বিদ্যায় একটু -আধটু মন গড়া কলমের আচড় ছোঁয়া।
শৈশব পেরিয়ে যখন কৈশোর বয়সে পা রাখলাম, সেই সময়ে হঠাৎ একদিন আমার বাবা হার্ট ষ্টোক করে মারা যান।
এই ক্ষুদ্র জীবনে যেটুকু সময় বাবাকে পেয়েছিলাম, সেটাই ছিল আমার সব চেয়ে বড় সৃতি।
বাবার আদর কুড়ানো মুখ,শাসন, স্নেহ,মমতা,সব কিছু যেন আজ সৃতি হয়ে রইলো।
তখন বাস্তবতার নিষ্ঠুর নীরবতা মেনে নেওয়ার মত আমার বয়স ছিলনা। তবে বেশ মনে আছে, বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন পরই আমার বড় ভাইয়া, আর ভাবি, সংসার থেকে আলেদা হয়ে শহরে চলে যান। সেই সময় আমার ছোট্ট ভাইটি, মায়ের দুধ পান করে। আমার মা অল্প বয়সে বিধবা হন। কিন্তু মা আমাদের ছোট ছোট ভাই বোনদের নিয়ে এতো চিন্তার মাঝে ও উনার চেহারায় এতোটুকু ছাপ ছিল না।
একদিকে স্বামী হারা,অন্যদিকে ছেলে -মেয়েদের কীভাবে মানুষ করবেন সে চিন্তায় তার দিন কাটতো।
উনার শেষ ইচ্ছে ছিল -জীবনে যতই দুঃখ - কষ্ট আসুক ছেলে -মেয়েদের মানুষ করতে হবে। যদি সন্তানদের মানুষ করা না যায় তবে মা হয়ে বেচেঁ থেকে কি হবে! সন্তানরা যদি সুখি হয় ,কিন্তু সেই কষ্ট সন্তানের মুখ দেখেই দূর করা যায়। সন্তান যদি প্রতিদানে এতটুকু সুখ দিতে না পারে সেই সন্তান পৃথিবীতে
বেচেঁ থাকার সার্থকতা কোথায়?
কিন্তু নিয়তির বিধান ছিল অন্যরকম!
আমার বাবা মারা যাওয়ার ছয়মাস পর একদিন হঠাৎ করে এমন এক ঝড় বৃষ্টি আসলো,
এই মহা প্রলয় ঘূর্ণিঝড়ে আমাদের ঘরবাড়ির সব কিছু ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। এত বড় দুর্বিপাক মা সহ করতে পারলেন না, মেঝের ওপরে বসে কেদেঁ ফেললেন, -"হায় আল্লাহ!...! হায় আল্লাহ গো......!!! .....আমি ও ...কেদেঁ উঠলাম।
পরের দিন আমাদের পরিবার এবং ঘরের জিনিস পএ নিয়ে এক নিকট আত্মীয়দের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। বুঝতে পারলাম, আমাদের জীবন, স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ অনিচ্ছিত হয়ে পড়েছে। হ, কি আর বলব, হে বন্ধু, আমি আমার নিজের আত্মাকাহিনির কথা বলছি,
এবার বলি, আমার স্কুল জীবনের কিছু কষ্ট -সৃতি কথা,
স্কুল লাইফের শেষ সৃতিটা ছিল এই রকম,ক্লাস ফোর পড়া শেষে যখন ফাইভে ভর্তি হলাম ; আমার পায়ে ছিল মায়ের এক জড়ো ছিঁড়া জুতো; আর পরনে বহুদিন আগের বাবার দেওয়া ছিঁড়া লাল সুইটার। তা দেখে ক্লাসের ছেলেরা আমার পিছনে ট্টা ট্টা বিদ্রপ করা শুরু করলো।
গরীব বলে জন্মেছি বলে, স্কুলের সব ছেলে-মেয়েরা ও শিক্ষক মশাই থেকে আমাকে অপছন্দের দৃষ্টিতে দেখতেন; তার আরেকটা কারণ ছিল অবশ্য, আমি ছিলাম একটু দুষ্টু প্রকৃতির।শুরুতে যখন ইসকুলে পা রাখি তখন কিছু ছেলেদের সাথে মারামারি করতাম ;এটা করে আমি ভিশন আনন্দ পেতাম। অন্তত :রোজ একটা ছেলের সাথে ঝগড়া না করে আমি একদমই থাকতে পারতাম না। আসলে আমি এসব মন থেকে করতাম না, শুধু দুষ্টামির চলেই করতাম। কিন্তু সব ছেলেরা ভাবতো আমি ইচ্ছে করেই কারণে-অকারণে ঝগড়া করি।
এ নিয়ে বেশি বাড়াবাড়ির ফলে দু 'একজন ছেলের সাথে ঝগড়া হলো। তার জন্যে ওই ছেলে গুলো আমার নামে স্যারের কাছে নালিশ করলো '
আমি নাকি বিনা কারণে সবার সাথে ঝগড়া করি?
পরের দিন স্কুলে যাওয়া মাএই শিক্ষক
মশাইদের কাছে রাজ্যের কৈফিয়ত দিতে হলো।
এই নালিশ গুলো ছিলো ওদের মন গড়া ; কারণ আমি যে মজা করার জন্য এসব করেছি কেউ বুঝতে পারলোনা। সেই দিন রাগে-ক্ষুদে তীব্র অভিমান নিয়ে অশ্রুজল হয়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। এখানেই ছিলো আমার স্কুল জীবনের সমাপ্তি।অবশেষে সব কিছু বাদ দিয়ে আমি কর্মজীবনে চলে গেলাম। ছোট্ট ভাই বোন, আর মায়ের কষ্টের কথা ভেবে টাকা -পয়সা রোজগারের জন্য চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে একটা চাকরি খুঁজে বের করি। শুর হলো অন্য এক জীবন। প্রতি মাসে যতো টাকা বেতন পাইতাম, মায়ের জন্য পাঠিয়ে দিতাম।
তখনো কলম হাত থেকে ছাড়িনি।কর্মস্হলের শত ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে সকল বাধা অতিক্রম করে নিরন্তন লেখা-লেখি চালিয়ে যেতাম। আমি লিখি ভিন্ন -ভিন্ন বিষয়ের উপরে - যেমন :
মুক্তিযুদ্ধের নানান বিষয়ক গল্প, প্রেমের গল্প, কবিতা ইত্যাদি। যদিও ভালো লেখা প্রকাশ হয়নি। কিছু লেখা গল্প,প্রবন্ধ, কবিতা বিভিন্ন জাতীয় প্রএিকায় একশোটির মত ছাপা হয়েছে। কেবল নিজের জন্য নয়, আমি লিখতাম দেশের জন্যে,মানুুষের জন্যে, সৃষ্টিসুখের জন্যে,আমার যে লেখাগুলো এখনো ছাপা হয়নি সে জন্যে আমার বেশিরভাগ সাহিত্য রচনাই ডায়রির পাতায়
সীমাবদ্ধ আছে। আমার লিখনি গল্প পড়ে মানুষ হাসবে, কাঁদবে, আমার গল্প মানুষের জীবনের কথা বলবে, জানবে, বুঝবে, শিখবে, এতেই আমার স্বার্থকতা। যখন আমি চট্টগ্রাম ছিলাম আমার
লেখার জগতে এসে পেলাম অসংখ পাঠক -পাঠিকাদের ভালোবাসা,এবং অনুপ্রেরণা। আর সাহিত্য আড্ডার চলে পরিচিত হলো অনেক তরুণ লেখক-লেখিকাদের মুখ।
তারাঁ আমার আত্মার সাথে মিশে থাকে সারাক্ষণ।
কিন্তু হায়!
আজ প্রবাসে এসে সব কিছু হারিয়ে ফেললাম। এখন আর লেখালেখির সময় হয়ে ওঠে না।শুধু কাজ
নিয়ে বেস্ত থাকতে হয়।
এখন আর পাইনা কারো ভালোবাসা,কারো অনুপ্রেরণা।
কাউকে পাঁচ -দশ -মিনিট সময় করে ফোনে সময় দিতে পারিনা বলে সময়ের ব্যবধানে আজ বন্ধু -বান্ধব,প্রিয়জন, একের পর করে সবাই আমাকে ভুলে গেল। দেশকে প্রচন্ড ভালোবাসি আমি।
নিজের মাতৃভূমি ছেড়ে পরবাসী এসেছি বলে -এখন আর আমাকে কেউ মূল্য দেয়না। তারা জানে না হয়তো, আমি পরবাসী হলেও আমার অন্তরে থাকে সর্বক্ষণ দেশ ও মাটির টান।
কত স্বপ্নিল,আর কত বর্নিল ছিল দিনগুলো,
আজ প্রবাস জীবনে এসে বুঝতে পেরেছি জীবনে অনেক বড়ো ভুল করে ফেলেছি। কিন্তু বুঝলাম অবশেষে সব কিছু হারিয়ে। প্রবাস নামক এই যান্ত্রিক জীবন আমার ভালো লাগে না। এখানে জীবন কাটে বন্দি পাখির মত। না পারি একটু স্বাধীণভাবে চলাফেরা করা, না পাই মায়ের আদর , মমতা, না দেখাপাই ভাই -বোন, বন্ধু-বান্ধব, এবং
প্রিয় মানুষ গুলোর দেখা। কেন যে জেনে শুনে ভুল করে বসলাম ?
আজ সেই ভুলে ভুলেই হয়তো জীবনটা শেষ হয়ে যাচ্ছে!
নিজ মাতৃভূমিতে দিনগুলো অনেক সুখের ছিল আমার।
কত আশা -কত স্বপ্ন নিয়ে বিদেশে এসেছিলাম!
ভেবেছিলাম বেশি -বেশি টাকা পয়সা পেয়ে নিজের পরিবারকে সুখী করে তুলবো।
কিন্তু হায়!
আমার কপাল এতটাই পোড়া যে,
বিদেশ বিদেশ নাম দিয়ে এতগুলো টাকা খরচ করে এসেছি।
দীর্ঘ চারটি বছর কেটে ও আসল টাকা জোগাড় করতে পারিনি।
অল্প টাকা বেতন পাই বলে কেউ দেয়না দাম।
সকাল হলেই ইদুঁরের মত কাজে ছুটে যাই, অনেক রাত করে বাসায় ফিরে আসি।
প্রচন্ড গরমে মাথার ঘাম পায়ে ঝড়ে পড়ে ; আর অনিয়ম পরিশ্রমে শরীর ভেঙে পড়ে।
এভাবে কাজে কাজে জীবন শেষ হয়ে আসে প্রতিনিয়ত।
এভাবে মাসের পর মাস কেটে যাই,
বেতন পাইনা সময় মত।
রাতে বিছানায় ঘুমাতে চারপোকার কামড়ের জ্বালায় ঘুম আসে না। মাথার ভেতর শুধু একটাই টেংশন থাকে কখন যে পাওনাদারদের টাকা শোধ করব? এসব চিন্তা-ভাবনায় সারারাত ঘুম আসে না। শুধু ভাবি কখন দেশে ফিরে যাবো?
দেশের সবাই হয়তো ভাবছে -আমি অনেক সুখে আছি। আমার কাছে টাকার পাহাড় জমেছে! কিন্তু আমি!
হে বন্ধু,
আমি কি করি তোমরা কি জানো?
অল্প টাকা বেতন পেয়ে নিজ পরিবারকে সুখী করার জন্য
একেক সময় আলুর ভর্তা,ডাল,
নোন পানি দিয়ে ভাত খেয়ে টাকা বাচিঁয়ে দেশে পাঠাই।
অথচ পরিবাররা বিশ্বাস করেনা।
মা বলে, আমি নাকি বৌয়ের একাউন্টে টাকা জমা রাখি! আর বৌ বলে আমি নাকি টাকা পয়সা বেপথে উড়িয়ে ফেলি! কেউ বিশ্বাস
করেনা। এমন কি নিজের মা ও না।
এবার ভাবো, কী কষ্ট আর তীব্র অপমান নিয়ে বেচেঁ আছি!
কত ব্যাথা জমে রয়েছে বুকের ভেতর! আমার দুঃখ বোঝার মত পৃথিবীতে কেউ নেই।
জীবনটাকে আজ আমার কাছে অর্থহীন বলে মনে হয়!
মনে হয় জীবনটাই যেন খেলনা, অর্থহীন! মাঝে মাঝে আত্মা হত্যা করতে ইচ্ছে করে! এই জীবনের কী -ই-বা মূল্য আছে আর!
আমি জানি আত্মা-হত্যা মহা
পাপ! কেউ আমার কষ্ট না বুঝক তবুও অন্তত নিজের জন্য আমাকে বেঁচে থাকতে হবেই।আমি বেচেঁ থাকবো নিজ পরিবার, বন্ধু -বান্ধব, এবং প্রিয় মানুষ গুলোর জন্য।
কতকিছু ভাবি এখন, কতকিছু মনে পড়ে আজ, ভেবে পাইনা কুল।
অতীত দিনের সুখের দিনগুলো আজ পরবাসী দেশে এসে বড়বেলায় এসে জীবন অনেকটা পিকে হয়ে গেল। আজ এসব সৃতি হয়ে বুকের ভেতর গেথেঁ রইল। সময়ের সোতে জীবনের রুক্ষ প্রয়োজনে, এখন পরবাসীর কীট (!)
আজ মরুভূমি দেশে জীবনটা যান্ত্রিক হয়ে গেলো।
আজ আমি কারা গন্তব্যে বুঝতে পেরেছি, পৃথিবীর অমোখ বিধানে সব কিছুই বদলে যায়। সকালের ঝকঝকে রোদ দুপুরে গড়ায়, দুপুর গড়িয়ে অপরাহ্নের দীর্ঘতর হয়। নামে রাত। মানুষের জীবন ও তেমনি। মেঘে মেঘে বেলা বেড়ে যায়।কাটের নিচে ছাপা পড়ে রয় সৃতিময় অতীত জীবন।
তাই আমি মনে মনে ভাবি -
" জীবনটা আজ সাদাপাতা ...
লেখার কিছুই নেই।
মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে আছি ...
পুরনো আমি সেই।
হঠাৎ করে কেনো আজ,
কাঁদে আমার মন...
পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি ...
হারিয়ে গেছে আমার আপনজন...।"
এরই নাম বুঝি প্রবাস জীবন।